ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। অধ্যাপনা করছেন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকট, সংকট উত্তরণে করণীয় প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। বলেন, সুশাসন ও জবাবদিহি না থাকার কারণেই এই সংকট। বাণিজ্য ঘাটতি দ্রুত কমিয়ে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলেও মত দেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু
জাগো নিউজ: গত কয়েক বছরে দেশের উন্নয়ন দৃশ্যমান। সরকার এখন কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: একটি রাজনৈতিক দল তার কর্মকাণ্ড নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করবেই। এটি তার রাজনৈতিক কৌশল। সরকার মেগা প্রকল্পগুলো নিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাবেই। বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েছে তার সঙ্গে কয়েকটি কারণ সম্পৃক্ত বলে মনে করি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। আমদানি-রপ্তানির মধ্যে বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
আমরা এককেন্দ্রিক রপ্তানির দিকে গিয়েছি। রপ্তানির বৈচিত্র্য নেই বললেই চলে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। জোগান কম। চাহিদা বেশি। দুর্নীতি চরম মাত্রায়। ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট রয়েছে। নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা রয়েছে। ব্যাংকব্যবস্থা সঠিক ভূমিকা রাখতে পারেনি। বিষয়গুলো তো চেইনের মতো। একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত। এই অব্যবস্থাপনা তো দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। চাইলেই চট করে সংকট দূর করা সম্ভব হবে না।
সরকার তো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। যেমন- মালয়েশিয়ায় জনবল পাঠানোর কথা। কিন্তু থমকে আছে। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ আছে কি না তা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। তবে আমি মনে করি, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফরেন রিজার্ভ, মূল্যস্ফীতি, আমদানি-রপ্তানি ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি।
জাগো নিউজ: এই নিয়ন্ত্রণ কীভাবে সম্ভব?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: সবার আগে আমদানি-রপ্তানির মধ্যকার ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে। তবে এটিও যে চট করে সম্ভব তা নয়। আমাদের তো রপ্তানি একমুখী। পোশাকশিল্পের বাইরে আর কোনো পণ্যে জোর দিতে পারিনি। আবার আমদানি কমিয়ে দিলে শিল্পের মারাত্মক ক্ষতি হবে। অনেক কাঁচামাল আমদানি করে উৎপাদন করতে হয় আমাদের।
সরকারের কঠোর নজরদারি দরকার এখন। মুদ্রাপাচার বন্ধ করতে হবে। পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে হবে। অনেক টাকা বাইরে পড়ে আছে। ব্যাংকগুলো এজন্য দায়ী। তাদের তাগিদ দিতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়ানোর উপায় বের করতে হবে। তাহলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আসতে পারে।
জাগো নিউজ: স্বাধীনতার পর প্রথম এত বেশি বাণিজ্য ঘাটতি। রপ্তানি আয়ও তো বাড়ছে। বাণিজ্য ঘাটতির এই সূচকের মধ্য দিয়ে আসলে কী প্রকাশ পাচ্ছে?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: বাণিজ্য ঘাটতি ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছিল। এখন বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্য বহুগুণে বেড়ে গেছে। কোভিডের পর এটি দেখা দিয়েছে। আমরা তো রপ্তানি খুব বাড়াতে পারিনি। রপ্তানি আয় বাড়ছে ঠিক। কিন্তু আমদানি ব্যয়ের তুলনায় খুব কম।
জাগো নিউজ: এখন কী করণীয়?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: অতিপ্রয়োজনীয় পণ্য ছাড়া আমদানি না করাই ভালো। বিলাসদ্রব্য আমদানি ঠেকানো জরুরি। অন্যদিকে শুধু তৈরি পোশাকের ওপর নির্ভর না করে রপ্তানির ক্ষেত্র আরও বাড়ানো দরকার। পাট, চামড়া, চায়ে জোর দিতে পারতাম। ইলেকট্রিক্যাল পণ্য রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব। হস্তশিল্প, তাঁতশিল্প, হোম টেক্সটাইল রয়েছে। প্রয়োজনে এসবে প্রণোদনা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এসবে কেন প্রণোদনা দেওয়া হয় না আমার বুঝে আসে না। এতে মানুষের কর্সংস্থান হবে। রপ্তানি আয় বাড়বে।
আসলে আমদানি প্রক্রিয়ায় কোনো অসঙ্গতি আছে কি না, তা আগে খুঁজে বের করতে হবে। আমদানির নামে টাকা পাচার হয়ে আসছে আগে থেকেই। এখন কী অবস্থায় আছে তা জানা জরুরি।
আর টাকার যে অবমূল্যায়ন হচ্ছে, তা কিছুটা মানতেই হবে। বিশ্ববাজার অস্থির। আপনি কিছুটা রোধ করতে পারবেন। কিন্তু একেবারে আগের জায়গায় ফিরে যেতে পারবেন না।
জাগো নিউজ: জ্বালানির সংকট তীব্র হচ্ছে। বিদ্যুতের উন্নয়নও হলো।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের পলিসি ঠিক ছিল না। আমাদের কোন পদ্ধতিতে বিদুৎ উৎপাদনে যাওয়া দরকার ছিল, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়নি। সরকার একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে আজকের সংকট তৈরি করেছে। গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো যায়নি। নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান করা যায়নি। কয়লা নিয়ে পরিকল্পনা নেই। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়েও তেমন উদ্যোগ নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে আরও গ্যাস আছে। মিয়ানমার, ভারত সমুদ্র থেকে গ্যাস তুলছে। আমরা কেন পারছি না?
আবার আমাদের নিজেদেরও সমস্যা আছে। আমরা তো বাইরের কোম্পানিকে বরদাস্ত করতেও চাই না।
জাগো নিউজ: বাইরের কোম্পানি তো আসলে জাতীয় স্বার্থবিরোধী।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: আপনি সক্ষমতা অর্জন করতে পারছেন না। করছেন না। বিদেশি কোম্পানির ওপর নির্ভর করতেই হবে। না করলে ভালো। কিন্তু উপায় তো বের করতে হবে। পারছেন না কেন?
অনুসন্ধান চালাতে প্রযুক্তি লাগে। হাজার কোটি টাকার দরকার পড়ে। চাইলেই আপনি ব্যয় করতে পারছেন না।
আমাদের সমস্যা হচ্ছে রাজনৈতিক। বিদেশি কোম্পানিগুলোকে যেভাবে হ্যান্ডেল করার কথা, তা পারিনি। এটি আমাদের দুর্বলতা। এর দায় তো বিদেশিদের দিয়ে লাভ হবে না। পছন্দের কোম্পানি নিয়েও অনেক রাজনীতি হয় এখানে। ষড়যন্ত্র হয়।
জাগো নিউজ: অনেকেই দেশের অর্থনীতিতে শ্রীলঙ্কার সিনড্রম দেখছেন। সরকারবিরোধীরাও সমালোচনা করতে গিয়ে এমন বলছে। আপনি কী বলবেন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার পথে আমি বিশ্বাস করছি না। সংকট নিরসনে শ্রীলঙ্কা ঠিক সময়ে ব্যবস্থা নেয়নি। সেখানে চরম মাত্রায় দুর্নীতি হয়েছে। অর্থপাচার হয়েছে। বিশেষ একটি গোষ্ঠী পলিসি নিয়েছে, সুবিধা নিয়েছে।
জাগো নিউজ: আর বাংলাদেশে?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: কিছু কিছু সিনড্রম আছে বটে। কিন্তু আমাদের এখানে এগিয়ে যাওয়ার গল্পও আছে। তারা ট্যুরিজমের ওপর জোর দিয়েছিল। করোনায় ধস নেমেছে। শ্রীলঙ্কার হোটেলগুলোয় বোমা হামলা আরেকটি কারণ, যা আজকের পরিস্থিতি তৈরিতে সহায়তা করেছে। গার্মেন্টস সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জাগো নিউজ: পরিস্থিতি কীভাবে সামাল দেওয়া যেতে পারে?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে। সবার আগে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। অর্থপাচার রোধ করতে হবে। জবাবদিহি বাড়াতে হবে। এসবের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার। আসল কথা হচ্ছে, জনগণের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। জনগণ ভুগছে। ভুক্তভোগীর কথা না শুনলে আপনি সমাধান করবেন কীভাবে?