মজনুর রহমান আকাশ, মেহেরপুরঃপঞ্চম শ্রেণিতে পড়ালেখার সময় পরিবারের চাপে মাত্র ১২ বছর বয়সেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল নুরজাহান খাতুনকে। বিয়ের পর আর বিদ্যালয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি তার। লেখাপড়া শিখতে না পারার কষ্ট বুকে নিয়ে শপথ করেছিলেন ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। আর সেটাই হয়েছে। নুরজাহান খাতুনের ১০ সন্তান আজ উচ্চ শিক্ষিত ও সকলেই কর্মরত।
অশিতীপর সংগ্রামী এই মায়ের বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার গাঁড়াডোব গ্রামে। তিনি মরহুম কোবাদ আলী শেখের স্ত্রী।
জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে এক মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় নুরজাহান খাতুনের স্বামী কোবাদ আলী মারা যান। ১০ ছেলেমেয়ে নিয়ে তখন কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়লেও তিনি ভেঙে পড়িনি। স্বামীর রেখে যাওয়া অল্প কিছু অর্থ দিয়ে প্রথমে বাড়িতেই কয়েকটি ছাগল পালন শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে হাঁস-মুরগি ও গরুর খামার করেন তিনি। জীবনের সাথে সংগ্রাম করেই ১০ সন্তানকেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। সবাই এখন চাকরিজীবী।
নুরজাহান খাতুনের বড় ছেলে আনিসুর রহমান কুষ্টিয়া জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, মেজো ছেলে আনছারুল হক ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালিত মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের পরিদর্শক, তৃতীয় ছেলে এসএম আইনুল হক বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি ও বর্তমানে সুইডেনে নাগরিকত্ব অর্জন করে সেখানকার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন, চতুর্থ ছেলে মাসুদুজ্জামান সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, পঞ্চম মেয়ে নাছিমা খাতুন গাংনী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত।
এছাড়াও ষষ্ঠ ছেলে শাহাজাহান আলী গাংনী উপজেলা হিসাব রক্ষণ অফিসে সিনিয়র অডিটর, সপ্তম ছেলে আলমগীর হোসেন একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত, অষ্টম মেয়ে নাজমা খাতুন মেহেরপুর জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত, নবম ছেলে জিল্লুর রহমান বেসরকারি প্রাইম ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত। কনিষ্ঠ মেয়ে তাসলিমা আক্তার বিসিএস নন ক্যাডারে কুষ্টিয়া ভূমি অফিসে কর্মরত রয়েছেন।
‘সফল জননী’ হিসেবে নুরজাহান খাতুন গাংনী উপজেলা পর্যায় ও মেহেরপুর জেলা পর্যায় থেকে স্বীকৃতি সরুপ ২০২৩ সালে পেয়েছেন জয়িতা ও রতœগর্ভা পুরস্কার।
নুরজাহান খাতুন জানান, জীবনের সব ক্ষেত্রে তিনি সফলতা পেয়েছেন। ছেলেমেয়েদের সফলতায় তিনি গর্বিত। তিনি আরো জানান, জীবনে অবহেলিত ও নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করতে এবং সমাজের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিতে সন্তানদেরকে সব সময় পরামর্শ দেন। কঠিন সময়ে ভেঙে না পড়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘যেকোনো কাজে সদিচ্ছা, সততা, স্বচ্ছতা ও চেষ্টা থাকলে মানুষ সফল হবেই। কারো ওপর নির্ভর না করে নিজের জীবন নিজেকেই গোছাতে হবে। সফল হওয়ার পেছনে এটাই হচ্ছে মূলমন্ত্র’।
প্রতিবেশিরা জানান, স্বামী মারা যাবার পর নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে দিনপাত করেছেন তবুও সন্তানদেরকে পড়ালেখা থেকে বিরত রাখেন নি। নিজেই জিবন সংগ্রাম করেছেন আর সন্তানদেরকে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তোলার চেষ্টায় তিনি সফল। তার সন্তানরাও অত্যন্ত ভদ্র ও মার্জিত স্বভাবের। সকলকে এমন মায়ের মত হবার আহবান জানান প্রতিবেশিরা।
তার মেয়ে গাংনী উপজেলা মহিলা বিষয়ক অফিসার নাছিমা খাতুন বলেন, আমার মা খুব ভালো মানুষ। তিনি সব বাধা পেরিয়ে একজন সফল নারী। আমার বাবা মারা যাবার পর পরিবারে হাল ধরার মতো কেউ ছিল না। মা একাই ১০ ভাইবোনকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছেন। বাবা যখন মারা যান আমরা কেউ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ কলেজে, কেউ মাধ্যমিক নয়তো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি। আমাদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে গিয়ে গ্রামের মানুষের কাছেও তাকে শুনতে হয়েছে নানা ধরনের কটু কথা। তারপরেও তিনি থেমে যাননি। সবকিছু উপেক্ষা করে আমাদের মানুষ করেছেন।