আব্দুস সবুর তানোর; রাজশাহীর জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিগত ২০০৮ সালের আগে সন্ত্রাসের অভয়শ্রম ছিল উত্তরের জনপদ, বিএনপি সন্ত্রাস লানল পালন করে,আমরা সেটা দুর করে উন্নয়ন করি, তাদের আর আমাদের সরকারে মাঝে এটাই পার্থক্য।আওয়ামী লীগ জনগণকে দিতে আসে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে জনগণ পায়। এটা হলো বাস্তব কথা। আমরা মানুষের জন্য কাজ করি। আর বিএনপি, ওরা কী করে? মানুষ খুন করে, অগ্নি-সন্ত্রাস করে’।আজ রোববার বিকেলে রাজশাহীর ঐতিহাসিক মাদ্রাসা ময়দানের জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এসব কথা বলেন। রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ এই জনসভার আয়োজন করে। শেখ হাসিনা এই জনসভা থেকে আগামী নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার জন্য রাজশাহীর মানুষকে ওয়াদা করান। জনসভায় উপস্থিত সবাই দুই হাত উঁচিয়ে আগামী নির্বাচনেও নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রীকে। বক্তব্যের শুরুতেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামানসহ জাতীয় চার নেতা এবং পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের শহীদদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশ স্বাধীন করেছিলেন। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটা করে যেতে পারেননি। আপনারা জানেন, ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করে। একই সঙ্গে হত্যা করে আমার মা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। ছোট্ট ভাই রাসেলকেও। আমি আর আমার ছোট বোন বিদেশে ছিলাম। আমরা দেশে আসতে পারিনি। রিফিউজি হিসেবে বিদেশে থাকতে হয়েছিল ছয়টি বছর। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতি। আমার অবর্তমানে আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করে। আমি এই দেশে ফিরে আসি—এমন একটি দেশে, যেখানে আমার কোনো বিচার চাওয়ার অধিকার ছিল না। জাতির পিতার খুনিদেরকে ইনডেমনিটি দিয়ে বিচারের হাত থেকে রেহাই দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতায় বসানো হয়। সেই অবস্থায় আমি দেশে ফিরে আসি শুধু বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য ফেরানোর লক্ষ্য নিয়ে। সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য নিয়ে, যেভাবে আমার বাবা জাতির পিতা চেয়েছিলেন এই বাংলাদেশকে গড়তে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘৪০ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যঘাটতি ছিল। জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া কেউ এ দেশের মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা দেয়নি, চিন্তাও করেনি। আওয়ামী লীগ সরকার এসে বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনে কাজ শুরু করে। রাজশাহীতে জাতির পিতা স্বাধীনতার পর কলকারখানা চালু করে দেন। এরপর সবই বন্ধ হয়ে যায়। আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর আমরা কাজ করি। পদ্মা নদীর ভাঙন থেকে রক্ষার জন্য দীর্ঘ বাঁধ করে দিয়ে সেই ভাঙন আমরা রোধ করে দিই। এখানে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেই। ইতিমধ্যে আমরা অনেকগুলো পদক্ষেপ নিয়েছি রাজশাহীর মানুষের জন্য।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘জাতির পিতা এখানে সুগার মিল, টেক্সটাইল মিল, জুটমিল করে দিয়েছিলেন। গোদাগাড়ীতে ডেইরি ফার্ম। এমনকি রেশম শিল্প পর্যন্ত ধ্বংস করে দিয়েছিল পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারেরা। আমরা আমাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যাতে এটা হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারে আসে। বিএনপি অনেক কথা বলে। তারা আমাদেরকে নোটিশ দেয়। আমরা নাকি পালানোর পথ পাব না। এই বিএনপি-জামায়াত জোট যারা হয়েছে, তাদের জিজ্ঞেস করি, পালায় কে? আওয়ামী লীগ কখনো পালায় না। পিছু হটে না। ওই জিয়াউর রহমান বাধা দিয়েছিল দেশে আসতে দেবে না। আমি বাধা অতিক্রম করেই দেশে ফিরে আসি। ২০০৭ সালে যখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসে, তখনো আমাকে দেশে ফিরতে দেবে না। আমি জোর করে দেশে ফিরে এসেছিলাম। আমার বিরুদ্ধে মার্ডার কেস দেওয়া হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আমি যাব এই কেস মোকাবিলা করব। আমি দেশে ফিরে এসেছি শুধুমাত্র এই বাংলার মানুষের কথা চিন্তা করে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিএনপি আজকে বলে, পালানোর সুযোগ পাবে না আওয়ামী লীগ, আমি তাদের বলতে চাই আওয়ামী লীগ পালায় না, পালায় আপনাদের নেতারা। বিএনপির নেতারা কে? বিএনপি নাকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবে। কাকে নিয়ে? দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্ত তাদের এখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, যে নাকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে স্ট্যাম্প কাগজে মুচলেকা দিয়েছিল, আর কখনো রাজনীতি করবে না বলে দেশ থেকে ভেগে গিয়েছিল, সেই কথা কি আমাদের বিএনপি নেতাদের মনে নেই। দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্ত খালেদা-তারেক। খালেদা জিয়া তারেক-কোকোর মাধ্যমে যে টাকা পাচার করেছিল মানি লন্ডারিং করে, তার ৪০ কোটি টাকা আমরা বাংলাদেশে ফেরত নিয়ে এসেছি। এর জবাব কি তারা দিতে পারবে? আওয়ামী লীগ কখনো পালায় না, আওয়ামী লীগ জনগণকে নিয়ে কাজ করে। এই সংগঠন জাতির পিতার হাতে গড়া সংগঠন। এই সংগঠন যখনই ক্ষমতায় এসেছে, দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘আজকে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। ৪০ ভাগ দারিদ্র্যসীমা আমরা ২০ ভাগে নামিয়েছি। বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, সমস্ত ভাতা দিয়ে যাচ্ছি। মা-বোনদের মাতৃত্বকালীন ভাতা আমরা দেই। আমাদের এই দেশের একটা মানুষও গৃহহীন-ভূমিহীন থাকবে না। প্রত্যেকটা মানুষকে বিনা পয়সায় দুই কাঠা জমিসহ ঘর করে দিচ্ছি, যারা বাকি আছে তাদেরও করে দেব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দেশে কোনো মানুষ গৃহহীন থাকবে না। কোনো মানুষ না খেয়ে থাকবে না। এই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
রাজশাহীর উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই রাজশাহী সব সময় অবহেলিত ছিল। আপনারা বিগত মেয়র ইলেকশনে আমাদের ভোট দিয়েছেন। আমি আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাই। কৃতজ্ঞতা জানাই। এই রাজশাহীতে কিছুক্ষণ আগে কতগুলো প্রকল্প উদ্বোধন করলাম। ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত এই ১৪ বছরে শুধুমাত্র রাজশাহী জেলা ও মহানগরে ১০ হাজার ৬৬০ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প আমরা বাস্তবায়ন করে দিয়েছি। এই মহানগরে ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প আমরা বাস্তবায়ন করেছি। আজকে কিছুক্ষণ আগে ১ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকার ২৬টি প্রকল্প উদ্বোধন করলাম। ৩৭৫ কোটি টাকার ৬টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলাম। এই প্রকল্পগুলি আপনাদের জন্য আমি উপহার হিসেবে দিয়ে গেলাম।’বিএনপির সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অনেকে আপনারা জানেন না, জিয়াউর রহমান যখন মারা গেল, তখন দেখা গেল কী? কিছু রেখে যায় নাই। একটা ভাঙা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি ছাড়া। পরে দেখা গেল, সে ভাঙা স্যুটকেস কোথায়! খালেদা জিয়ার মূল্যবান শাড়ি ফ্রান্স থেকে কিনে আনে। এত টাকা চুরি করে বিদেশে পাচার করেছে যে, এখন যান আপনারা দেখবেন কীভাবে আয়েশি জীবনযাপন করেছে। আর আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি, সেই ডিজিটাল মাধ্যমে আমাদের গিবত গায়, আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। আর মানুষকে উসকানি দেয়—এটাই তাদের কাজ। বাংলাদেশের মানুষের কোনো ভালো তারা সহ্য করতে পারে না। এটা হলো বাস্তবতা। এরা অপকর্ম-লুটপাট করতে পারে। বাংলা ভাই সৃষ্টি করে এই রাজশাহীতে অস্ত্রসহ প্রকাশ্যে দিবালোকে তারা মিছিল করে, আর পুলিশ দেয় তাদের পাহারা। অবৈধ অস্ত্র নিয়ে মিছিল করে পুলিশ পাহারা দেয়। এই তো খালেদা জিয়ার ২০০১ থেকে ২০০৬। তাদের দুর্নীতি-অনিয়ম, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, যার ফলে বাংলাদেশে ইমার্জেন্সি ডিক্লেয়ার হয়। তা ছাড়া কোনো কারণ ছিল না। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণেই এটা হয়েছে। তারা সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ ছাড়া কিছু বোঝে না। আওয়ামী লীগ সরকার থাকলে মানুষের শান্তি থাকে। দেশের উন্নতি হয়। আমরা যে ওয়াদা দেই, তা রক্ষা করি। ২০০৮-এর নির্বাচনে বলেছিলাম, রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়ন করব। আমরা তা করেছি। আজকের বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। আগামীতে বাংলাদেশকে আরও উন্নত করতে চাই। প্রত্যেকটা যুবক কাজ পাবে।’
আগামী নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘পদ্মা সেতু করে দিয়েছি। এর আগে যমুনায় বঙ্গবন্ধু সেতু করে দিয়েছিলাম। সমস্ত বাংলাদেশের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এসে গেছে। বন্ধ থাকা এয়ারপোর্ট আমরা চালু করে দিয়েছি। আমরা চাই আমাদের দেশ এগিয়ে যাক। দেশের উন্নতি হোক। করোনাকালীন সময়ে আমি আসতে পারিনি। আজকে আপনাদের মাঝে এসে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। গত নির্বাচনে নৌকা মার্কায় আপনারা ভোট দিয়েছেন। সে জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলব, আগামী নির্বাচন আসবে এই বছরের শেষে অথবা আগামী বছরের শুরুতে। আপনারা নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন কি না ওয়াদা চাই।’ এ সময় জনসভায় উপস্থিত সবাই দুই হাত তুলে আগামী নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের বিজয়ী করার প্রতিশ্রুতি দেন।
জনসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সম্পাদক ও তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, সাবেক শিল্পপ্রতিমন্ত্রী সাবেক জেলা সভাপতি এমপি ওমর ফারুক চৌধূরীসহ কেন্দ্রীয় এবং স্থানীয় অন্য নেতারা বক্তব্য দেন। সভাপতিত্ব করেন মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী কামাল।